খাবেন নাকি পোকা!
রণক ইকরাম প্রতিদিন আমাদের খাবার তালিকায় যোগ হচ্ছে নানান স্বাদের বিচিত্র সব খাবার। প্রচলিত খাদ্যশস্য আর প্রাকৃতিক উপাদানের সংকট ও একঘেয়েমি দূর করতে সবাই খুঁজছে বিকল্প খাদ্যের। আর সেই বিকল্প খাবার আর কিছু নয়, তা হচ্ছে বিভিন্ন জাতের পোকামাকড়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, খাদ্য সংকট অথবা রসনা বিলাস যে কোনোটির কারণে বিশ্বের নানা দেশে পোকামাকড় এখন দারুণ জনপ্রিয় খাবার। শুনতে গা রি রি করলেও বিশ্বজুড়ে খাবার হিসেবে পোকামাকড়ের জনপ্রিয়তা বাড়ছে বৈ কমছে না। আমাদের প্রাণিজগতের একটা বিশাল অংশজুড়ে পোকামাকড়ের দখল। অধিকাংশ পোকামাকড়ই আমাদের কাছে হয় ক্ষতিকারক, নতুবা অপাঙ্ক্তেয়। এরা দেখতে যেমন কুৎসিত, তেমনি অনেক পোকামাকড়েরই রয়েছে উগ্র গন্ধ আর বিষাক্ত হুল। এরপরও আস্তে আস্তে মানুষের খাদ্য তালিকায় ঠিকই জায়গা করে নিচ্ছে এরা। আফ্রিকা, এশিয়া তো বটেই, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এমন কি ইউরোপের অনেক দেশে খাদ্য হিসেবে পোকামাকড় এখন দারুণ জনপ্রিয়। আর এই পোকামাকড়ের খাবার তৈরি প্রণালীতেও রয়েছে অনেক বৈচিত্র্য। পতঙ্গভোজীরা রীতিমতো চিংড়ি, বাদাম কিংবা মসলা দিয়েই এসব পোকামাকড় রান্না করে থাকে, যা খেতে নাকি দারুণ সুস্বাদু। আরশোলা বা তেলাপোকার নাম শুনলেই রি রি করে গা। কিন্তু এর চাটনি চীনাদের অত্যন্ত প্রিয় খাবার। এ খাবার থাইল্যান্ডেও জনপ্রিয়। এছাড়া এখানে গুবরে পোকার তরকারি ছাড়া অতিথি আপ্যায়ন জমেই না। থাইবাসী জাল লাগানো এক ধরনের কাঠি দিয়ে জঙ্গল থেকে ধরে আনে লাখ লাখ কিলবিলে কীটপতঙ্গ। ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে, বস্তা ভর্তি করে বিক্রির জন্য পাঠানো হয় বাজারে। গ্রামবাসী শুকনো অবস্থায় খায় এগুলো। শুকনো কীটপতঙ্গ দিয়ে ওরা মজার মজার পিঠাও তৈরি করে।
ক্যারিবিয়ান সাগরের সুনীল জলে অবস্থিত ছোট্ট দ্বীপ জ্যামাইকা। এখানকার অধিবাসীরা গণ্যমান্য অতিথিদের এই ঝিঁ-ঝিঁ পোকা খেতে দেয়। তামিল প্রবাদে রয়েছে_ 'তুমি যদি এক হাজার পিঁপড়ে খাও, তবে একটি হাতির শক্তি লাভ করবে।' আমাদের গ্রামাঞ্চলেও কথিত আছে_ 'পিঁপড়া খেলে সাঁতার শেখা যায়।' এসব প্রবাদ সত্য হোক বা না হোক বিশ্বের অনেক স্থানেই পিঁপড়াকে খুব সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর খাবার মনে করা হয়। থাই রেস্তোরাঁগুলোতে পিঁপড়ার সুপ খুব জনপ্রিয়। পিঁপড়ার ডিমের তরকারি একটু বেশি দামি খাবার। আফ্রিকা, মেক্সিকো এবং ভারতের কিছু কিছু এলাকায় পিঁপড়ার কদর আকাশচুম্বী। এমন কি আমাদের রংপুর, দিনাজপুর এবং বগুড়া জেলার উপজাতীয় সাঁওতালরা পিঁপড়া খেতে ভীষণ পছন্দ করে। ব্যাংককের পূর্বাঞ্চলীয় শ্রী রাঁচা শহরবাসী অতিথি আপ্যায়নে এনে দেয় প্লেটভর্তি ঝিঁ-ঝিঁ পোকার মোরব্বা। থাইবাসীর খুব প্রিয় ও মুখরোচক একটি খাবার হলো পঙ্গপালের আচার। পিঁপড়া, উইপোকা, শুঁয়োপোকার শূককীট ও ফড়িং মাখনে ভেজে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে প্রীতিভোজের আয়োজন করা হয়। এখানকার হোটেল-রেস্তোরাঁর মেনুতে পাবেন মৌমাছির শূককীট, মথ, মাছি আর ঘুণপোকার সুপ। থাইল্যান্ডের বুড়ো আর বাড়ন্ত শিশুদের পুষ্টিকর স্বাস্থ্য টনিক হচ্ছে 'এসপনগোপাস' নামের বড় বড় গান্ধিপোকা। এই গান্ধিপোকা আসামের অনেক এলাকায় ভাতের সঙ্গে খাওয়া হয়। দক্ষিণ ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে ১২-১৪ বছরের কিশোরকে উইপোকার রানী ধরে খেতে দেওয়া হয়। উইপোকার রানী খেলে নাকি ছেলেরা ভালো দৌড়াতে পারে এবং এতে নাকি দৌড়-ঝাঁপজনিত ক্লান্তিও দূর হয়। ভারতের কিছু আদিবাসী 'এপিস ডরসেটা' নামে এক ধরনের জংলী মৌমাছির শূককীট ও পুত্তলি খায়। অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দারা 'এগ্রোটিস ইনফিউছা' নামক 'মথ' থলেতে সংগ্রহ করে নিয়ে কয়লার আগুনে ঝলসে এক ধরনের মুখরোচক খাবার তৈরি করে। এতে রয়েছে প্রচুর তেল আর এটি খেতে নাকি একেবারে বাদামের মতো। কানাডার ডালভেগান, ভ্যাঙ্কুভার অঞ্চলের লোকেরা ঘাস ফড়িংকে বিলাসবহুল খাদ্য হিসেবে গণ্য করে। ফড়িংগুলোকে প্রথমে আগুনে ঝলসে নেওয়া হয়। তারপর তা গুঁড়ো করে নরম আঠালো লেই তৈরি করা হয়। এই লেই ময়দার সঙ্গে মিশিয়ে রুটি তৈরি হয়। এ রুটি খেতে দারুণ উপাদেয়। শোনা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সশস্ত্র বাহিনীকেও রান্না করা খাসফড়িং খেতে দেওয়া হয়েছিল। চীনে আরও আগ থেকেই ডাইটিসসিডি গোত্রের মিষ্টি পানির পোকার চাষ শুরু হয়েছে। এসব পোকাকে পানি থেকে তুলে রোদে শুকানো হয়। ঠিক গরম কেকের মতোই এর বিক্রির বাজার। জুন-জুলাইয়ে আমেরিকার ওরিগন ও ওয়াশিংটনে কিছু লোক রাতের বেলায় মশাল জ্বেলে পাইন বন থেকে কলোরাডিয়া প্যানডেরা মথের শূককীট সংগ্রহ করে। তা থেকে তৈরি খাবার 'পি-অ্যাগ-গাই' ছেলেবুড়ো সবার প্রিয়। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো অঞ্চলের অধিবাসীরা গ্রাইল্লাস অ্যাসিমিলস বৈজ্ঞানিক নামের ঝিঁ-ঝিঁ পোকা খেতে পছন্দ করে। এই কালো-বাদামি পতঙ্গকে প্রথমে তারা আগুনে ঝলসে নেয়, তারপর মাখন ও লবণ মাখিয়ে পরিবেশন করে। পঙ্গপাল রান্নার প্রণালী একেক দেশে একেক রকম। মিসরের বেদুইনরা কয়লার আগুনে এগুলোকে জীবন্ত দগ্ধ করে পরম তৃপ্তিতে খায়। তবে আগুনে ঝলসানোর আগে এদের শরীর থেকে পাখা এবং পা ছাড়িয়ে নেয়। মরক্কোর অধিবাসীরা এই পোকা বাড়ির ছাদে শুকিয়ে তারপর আগুনে ঝলসে পরিবেশন করে। প্রাচ্যের অনেক স্থানে শস্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেখানকার অধিবাসীরা পঙ্গপাল ধরে এনে রোদে শুকিয়ে গুঁড়ো করে রুটি তৈরি করে খায়। গুবরে পোকার মোটাসোটা শূককীট নাকি খুবই উপাদেয়। দক্ষিণ আফ্রিকার মাদাগাস্কার ও মোজাম্বিকের লোকজন ওই লার্ভাকে কাঁচা চিবিয়ে খায়। গ্রিস ও রোমের সুসভ্য নাগরিকরাও গুবরে পোকার শূককীট থেকে তৈরি খাবার বেশ আনন্দের সঙ্গেই খেয়ে থাকেন। প্রশ্ন আসতে পারে পোকামাকড়ের তৈরি এসব খাবার কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত। আর আমাদের প্রচলিত খাবারের মতো এর কি খাদ্যগুণ রয়েছে? অবশ্যই আছে। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন এসব খাবারে প্রোটিনের ছড়াছড়ির কথা। প্রতি একশ গ্রাম ঘাস ফড়িংয়ে ৫৭ গ্রাম, গুবরে পোকায় ৬৪ গ্রাম, উইপোকায় ৩৮ গ্রাম আর পঙ্গপালে রয়েছে ৬০ গ্রাম প্রোটিন। আর স্নেহপদার্থ, শর্করা, লোহা, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন তো রয়েছেই। তাই শুনতে খারাপ বা বলতে বাজে শুনালেও খাদ্য হিসেবে পোকামাকড় মোটেও ফেলনা নয়। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় যদি পোকামাকড়ের প্রতি নাক সিটকানো ভাবটা ঝেড়ে ফেলা যায়, তাহলে দুর্গম জায়গা বা বনজঙ্গলে অবস্থানের সময় খাদ্য সংকট দেখা দিলেও কোনো অসুবিধা হবে না।
Source:www.bangladesh-pratidin.com